এসএমই লোন পাওয়ার নিয়ম জানেন কী? যদি এ সম্পর্কে না জেনে থাকেন তাহলে এই আর্টিকেলটি আপনার জন্য। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাংকিং কার্যক্রমে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলো যা তা এসএমই লোন নামে পরিচিত। বিশেষ করে উদ্যোগতাদের জন্য এই খাতটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে ও দেশের জিডিপিতে অবদান রাখে। আমাদের দেশের অনেক উদ্যোক্তা ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য অর্থের অভাবে পড়েন। এখানে এসএমই লোন একটি কার্যকর সমাধান হিসেবে কাজ করে। এই লোন পাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট নিয়মাবলী অনুসরণ করতে হয়। এ সকল নিয়মাবলী বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে নির্ধারিত। এই আর্টিকেলে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব এসএমই লোন পাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে। যাতে আপনি সহজেই আবেদন করতে পারেন। তবে প্রথমেই আমরা এসএমই লোন কী এ সম্পর্কে জেনে নিবো।
এসএমই লোন কী
এসএমই অর্থ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ, যার মাধ্যমে উদ্যোগতারা ব্যাংক থেকে লোন নিতে পারবেন। ক্ষুদ্র উদ্যোগতারা সম্পদের মূল্য ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যাংক থেকে লোন নিতে পারেন । মাঝারি উদ্যোগতারা সম্পদ ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত লোন নিতে পারেন যাদের কর্মী সংখ্যা ২৫০ জনের কম কর্মচারী। এই খাতটি দেশের ৯০% ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়ে গঠিত। এসএমই লোন এই উদ্যোগতাদের অর্থায়ন করে যাতে তারা বাড়তে পারে। বাংলাদেশে এসএমই খাত দারিদ্র্য হ্রাস করে ও নারী উদ্যোক্তাদের সুযোগ দেয়। সরকার ও বানিজ্যিক ব্যাংকগুলি এই খাতকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে কারণ দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। এখন আসুন এসএমই লোন পাওয়ার নিয়ম নিয়ে আলোচনা করা যাক।
আরও জানতে পারেনঃ অগ্রণী ব্যাংক এসএমই লোন
এসএমই লোনের যোগ্যতা
এসএমই লোন পাওয়ার জন্য প্রথমে যোগ্যতা পরীক্ষা করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে উদ্যোক্তাকে বাংলাদেশী নাগরিক হতে হবে ও ব্যবসা নিবন্ধিত (ট্রেড লাইসেন্স থাকতে) হবে। ব্যবসার অভিজ্ঞতা কমপক্ষে ২ বছর থাকা উচিত। ক্রেডিট হিস্ট্রি ভালো হওয়া দরকার হয়। অর্থাৎ পূর্বের লোনের খেলাপী নেই। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা আছে। যেমন: কম সুদের হার। ব্যবসার ধরনও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন: বাণিজ্য, উৎপাদন বা সেবা খাত। যদি আপনার ব্যবসা ক্লাস্টার ভিত্তিক হয়, তাহলে অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়া যায়। যোগ্যতা না থাকলে আবেদন প্রত্যাখ্যান হতে পারে। তাই, আগে থেকে চেকলিস্ট তৈরি করুন।
যোগ্যতার মূল শর্তসমূহ
- নাগরিকত্ব: বাংলাদেশী হতে হবে।
- ব্যবসার নিবন্ধন: ট্রেড লাইসেন্স থাকতে হবে।
- অভিজ্ঞতা: কমপক্ষে ২ বছরের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা।
- ক্রেডিট স্কোর: ভালো ক্রেডিট রেকর্ড।
- বয়স: ২১ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে।
এই শর্তগুলো পূরণ করে এস এম ই লোন পাওয়ার নিয়ম অনুসরণ করুন।।
এসএমই লোনের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস
এসএমই লোনের আবেদনের জন্য বিভিন্ন ডকুমেন্ট জমা দিতে হয়। এগুলো ব্যাংকের যাচাইয়ের জন্য দরকারী। প্রধান ডকুমেন্টগুলো হলো: জাতীয় পরিচয়পত্র (NID), ট্রেড লাইসেন্স, ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট (শেষ ৬ মাসের), আয়কর রিটার্ন (TIN) ও ব্যবসার প্রজেক্ট রিপোর্ট। যদি জামানত থাকে তাহলে সম্পত্তির কাগজপত্র দিতে হবে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অতিরিক্ত প্রমাণপত্র লাগতে পারে। এই ডকুমেন্টগুলো সঠিক না হলে আবেদন বাতিল হয়। তাই সবকিছু আপডেট রাখুন।
ডকুমেন্টসের লিস্ট
- NID বা পাসপোর্টের কপি।
- ট্রেড লাইসেন্স এবং ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন।
- ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট এবং ফিনান্সিয়াল স্টেটমেন্ট।
- প্রজেক্ট প্রপোজাল বা বিজনেস প্ল্যান।
- জামানতের ডকুমেন্টস, যদি প্রয়োজন হয়।
এই ডকুমেন্টস দিয়ে এস এম ই লোন পাওয়ার নিয়ম পালন করা সহজ হয়।
এসএমই লোন পাওয়ার নিয়ম
এসএমই লোনের আবেদন পদ্ধতি সহজ। প্রথমে ব্যাংক নির্বাচন করুন। যেমন: ব্র্যাক ব্যাংক বা ঢাকা ব্যাংক। তারপর অনলাইন বা অফলাইন ফর্ম পূরণ করুন। ডকুমেন্টস জমা দিন, ও ব্যাংকের অফিসারের সাথে লোন সম্পর্কে আলোচনা করুন। তারা আপনার ব্যবসা পরিদর্শন করতে পারেন। অনুমোদন পেলে লোন অনুমোদিত হয়। এই লোনেট প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে সাধারণত ১৫-৩০ দিন প্রয়োজন হয়।
ধাপসমূহ
- ধাপ ১: ব্যাংক নির্বাচন ও যোগাযোগ করুন।
- ধাপ ২: ফর্ম পূরণ করুন ও প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস জমা দিন।
- ধাপ ৩: যাচাই ও ব্যবসা পরিদর্শন ধাপ চলমান থাকবে।
- ধাপ ৪: অনুমোদন ও লোন প্রাপ্তি।
- ধাপ ৫: লোন পাওয়ার লোন নিয়মিত লোন পরিশোধ করুন।
এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এস এম ই লোন পাওয়ার নিয়ম মেনে চলুন।
এসএমই লোনের ধরন
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের এসএমই লোন আছে। উদাহরণস্বরূপ, ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন যা দৈনন্দিন খরচের জন্য। টার্ম লোন মেশিনারি কেনার জন্য। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ‘প্রবাহ’ লোন সিএমএসএমই-এর জন্য। ইসলামী ব্যাংকিং-এ শরিয়াহ ভিত্তিক লোন আছে। নারীদের জন্য বিশেষ লোন। এই ধরনগুলো ব্যবসার চাহিদা অনুসারে নির্বাচন করে থাকে। নিম্নে ছক আকারে লোনের ধরন সমূহ উপস্থাপন করা হয়েছে
লোনের ধরন | উদ্দেশ্য | সুদের হার (আনুমানিক) | মেয়াদ |
ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল | দৈনন্দিন খরচ | ৯-১২% | ১-৩ বছর |
টার্ম লোন | সম্পদ ক্রয় | ১০-১৪% | ৩-৭ বছর |
নারী উদ্যোক্তা লোন | নারী ব্যবসা | ৮-১০% | ২-৫ বছর |
ক্লাস্টার লোন | গ্রুপ ব্যবসা | ৯-১১% | ১-৪ বছর |
এই ছক থেকে দেখা যায়, এস এম ই লোন পাওয়ার নিয়ম ধরন অনুসারে ভিন্ন।
এসএমই লোনের সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ
এসএমই লোনের সুবিধা অনেক। এটি ব্যবসা বাড়ায়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। সুদের হার কম ও রিপেমেন্ট ফ্লেক্সিবল। তবে লোন নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান রয়েছে। যেমন: ডকুমেন্টসের জটিলতা, জামানতের অভাব। অনেকে ক্রেডিট হিস্ট্রি না থাকায় সমস্যায় পড়েন। তাই লোন নেওয়ার পূর্বে অবশ্যই নিজের ব্যাংক একাউন্টের ক্রেডিট হিসাব রাখুন।
এসএমই লোনের সুবিধা
- কম সুদের হার।
- দীর্ঘ মেয়াদ।
- সরকারী সহায়তা।
- ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ।
- নারীদের বিশেষ ছাড়।
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এস এম ই লোন পাওয়ার নিয়ম অনুসরণ করুন।
আরও জানতে পারেনঃ রূপালী ব্যাংক এসএমই লোন
এসএমই লোনের বিভিন্ন ব্যাংকের তুলনা
বাংলাদেশে অনেক ব্যাংক এসএমই লোন দেয়। ব্র্যাক ব্যাংক গ্রামীণ এলাকায় গ্রামীন উদ্যোক্তাদের লোন দেওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়াস করে থাকে ৭৫% অন্তর্ভুক্তি হিসেবে। ঢাকা ব্যাংকের i-সমাধান অনলাইন আবেদন সহজ করে। এবি ব্যাংক মোট লোনের ২৫% এসএমই-তে দেয়। সোনালী ব্যাংক দারিদ্র্য বিমোচনে সাহায্য করে। আপনার চাহিদা অনুসারে ব্যাংক নির্বাচন করুন।
ব্যাংক তুলনাঃ
ব্যাংক নাম | লোনের পরিমাণ (সর্বোচ্চ) | সুদের হার | বিশেষত্ব |
ব্র্যাক ব্যাংক | ৫০ লাখ | ১০% | গ্রামীণ ফোকাস |
ঢাকা ব্যাংক | ১ কোটি | ১১% | অনলাইন আবেদন |
এবি ব্যাংক | ৩ কোটি | ১২% | দীর্ঘ অভিজ্ঞতা |
মিউচুয়াল ট্রাস্ট | ২ কোটি | ৯% | শরিয়াহ লোন |
এসএমই লোনের টিপস ও সতর্কতা
আমাদের মধ্যে অনেক উদ্যোক্তা রয়েছেন যারা আর শুধুমাত্র আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য নিজেদের ব্যবসার সম্প্রসারণ করাতে পারছেন না। এই সকল উদ্যোক্তারা বিশেষ করে এসএমই লোন গ্রহণ করে আর তাদের ব্যবসার সমৃদ্ধি করাতে পারেন এজন্য অবশ্যই লোন গ্রহণ করার জন্য ভালো ব্যবসায়ীক পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন ও লেনদেনের ক্রেডিট স্কোর অবশ্যই ভালো থাকা প্রয়োজন। তবে আমাদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন ব্যবসায়িক পরিকল্পনা নেই তাদের জন্য মূলত এটি নয়। তবে লোন নেওয়ার পূর্বে অবশ্যই বিবেচনা করবেন আপনি লোনটি নেওয়ার জন্য উপযুক্ত কিনা ও লোনটি নিয়মিত পরিশোধ করতে পারবেন কিনা।
টিপস:
- বিজনেস প্ল্যান তৈরি করুন।
- ক্রেডিট হিস্ট্রি চেক করুন।
- একাধিক ব্যাংকের মাধ্যমে পরিকল্পনা করুন।
- প্রফেশনাল কোন ব্যক্তির সাহায্য নিয়ে লোনের সিদ্ধান্ত নিন।
- পরিশোধের পরিকল্পনা করুন।
শেষ কথা
প্রত্যাশা করি আজকের এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আজ আমরা আপনাকে বাংলাদেশে এসএমই লোন পাওয়ার নিয়ম এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পেরেছি। এসএমই লোন বিশেষ করে উদ্যোক্তাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এই লোনের মাধ্যমে উদ্যোক্তারা তাদের ব্যবসার সম্প্রসারণ করতে পারেন। আপনি যদি উদ্যোক্তা হয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই আপনার ব্যবসার সম্প্রসারেন জন্য এসএমই লোন নিতে পারেন। তবে লোন নেওয়ার পূর্বে বিবেচনা করেন আপনি লোনটির জন্য উপযুক্ত কিনা।